আমার নির্বাচন অভিজ্ঞতা

উপজেলা নির্বাচনের আগের দিন আমার বাবা ফোন করে জানালেন , তোমার ফুফা ত নির্বাচনে দাড়াইছে। বাড়ি যাবে?
আমার দাদা-নানা সব বাড়িতেই আমার এমন চমৎকার ইমেজ যে কোন কিছুর জন্য আমাকে কোনদিন ডাকা হয় না। আমার ফুফা ভাইস চেয়ারম্যান হতে চান- সেইটা আমি জানি নির্বাচনের আগের দিন।

যাই হোক বাবার সাথে গেলাম দাদা বাড়ি। বাড়ির কাছের প্রাইমারী স্কুল হলো কেন্দ্র। আর আমাদের প্রাইমারী টার্গেট ফুফাকে এইখানে পাস করাতে হবে।

দাদাবাড়ি হাইওয়ে থেকে বেশ দূর। হাইওয়ে থেকে নেমেই আমার বাবা ছোট একটা চায়ের দোকানে ঢুকে বসে গেলেন। আমাকে বললেন, আসো চা খেয়ে নেই।
চায়ের দোকান সেই রকম ময়লা। একটা বেঞ্চ ছাড়া আর কিছু নাই। আমার বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, এইটা আমাদের নিজের দোকানের মতই।
আমি মনে মনে বলি সেইটাই কারন। এমনিতে ত এইসব দোকানের সামনে দাড়াতে পর্যন্ত চাও না আর এখন খাচ্ছো চা।


রিকশা নিয়ে যেতে হয়। ত্রিশ মিনিট লাগে। রিকশায় উঠেই বাবা রিকশাওয়ালাকে বলল, তুই অমুকের ছেলে না?
-হ।
-তোর বড় ভাইটা বিয়ে করছে?
-গত বছর।
- এখনো কি মাছ বেচার কাজ করে?
-করে, লগে অন্য ব্যবসাও শুরু করছে।

আমি অবাক। একজন রিকশাওয়ালেরে শুধু চিনেনই না, তার ভাই কি করে সেটাও আমার বাবার মনে আছে। কিন্ত আমি নিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রেজাল্ট কি বা আমার পজিশন কত ছিল সেটা তিনি বলতে পারবেন না।
রাস্তায় যেতে যেতে দুনিয়ার সব মানুষের খোজ নিতে লাগলেন। আমার অবাক ভাবটা কমে আসল। ভেবে দেখলাম বাবা তার শৈশব আর কৈশোরের জায়গায় আসছেন। তার সব মনে থাকবে। অতি তুচ্ছ ঘটনাও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে।
আমি চাদপুরে বড় হইছি। আমার মনে হয় বিশ বছর পরেও শহরের প্রতিটা ঘাস আমি চিনতে পারব।

কপাল ভালো ছিল এইবারের দুইটা নির্বাচনে আমার ডিউটি পড়ে নাই।প্রথম নির্বাচনে(জাতীয় সংসদ) আমি সারাদিন রূমে ছিলাম। এত কষ্ট করে "না " ভোট দেয়ার জন্য কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছে করল না। ইন্ডিয়ার একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম ইলেকশনের দিন যদি আপনি ভোট না দেন- তবে আসলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন। কথাটা পুরাপুরি সত্য না। কারন সেইদিনের সারাটা আমি ঘুমিয়ে কাটাতে পারি নাই।



উপজেলার সময় বুঝলাম নির্বাচন কাকে বলে।

নির্বাচনে সাধারন মানুষ যে কি করে সেটা দেখে আসলাম। টাকা আসলে প্রার্থীরা যতটা না ছড়ায় তারচে দেখি পাবলিক টাকা নেয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। বাজারে এসে তাদের টার্গেট থাকে কার কাছ থেকে বিকালের নাস্তাটা আদায় করা যায়। এরপরের টার্গেট সিগারেট বা বিড়ির একটা প্যাকেট জোগার করা যায় কিনা। কেউ কেউ আছে স্মার্ট। চা খায় না, বিড়ি নেয় না। তাদের কথা ক্যাশ দেন। ক্যাশ না পেলে মুখের উপর বাজে কথা বলে দিবে। তাদের ভাষায় এইটা উচিত কথা। নির্বাচন শুরুর কিছুদিন আগে থেকেই এদের নবাবের চাল শুরু হয়। যে টাকা দিবে তার সাথে দুদন্ড কথা বলবে। টাকা না দিলে নাই। আবার সবার কাছ থেকেও টাকা খাচ্ছে। কিছু মানুষ যে আলাদা সেটা সত্য। কিন্তু কে জিতবে কে হারবে সেটা এরা ঠিক করতে পারে না। সবার যে একটা মাত্র ভোট।

আমাকে চিনে না গ্রামের সবাই। বলা বাহুল্য আমিও বেশিরভাগ মানুষকে চিনে না।অথচ এই অপরিচিত মানুষগুলা ময়লা দাত দেখিয়ে হেসে বলে টাকা দেন ত।
-কিসের জন্য?
-বিমানে ভোট দিমু টাকা দেন। তাদের বাক্য সংযম আর কথা সোজা করে বলা দেখে আমি অবাক আর মুগ্ধ। আসলেই ত কথা বাড়িয়ে লাভ কি? টাকা দেই-ভোট কিনি। নির্বাচনে জিতলে এই টাকা বহুগুনে তুলে নিয়ে আসা যাবে। এইটা তারাও জানে, আমিও জানি। যেই জিতুক এই মানুষগুলা ভবিষ্যত পালটায় না। তাই এরাও যতটা পারে নগদ নিয়ে নেয়।

আমার ফুফাকে কেন্দ্রে পাস করাতেই হবে। দাদা জানালেন, গ্রামের সব বাড়িতে মোটামুটি টাকা দেয়া হয়েছে। রাতে আমি আর বাবা বাজারে গেলাম। যাকে পাইছি তাকেই ধরে এনে চা খাওয়ালাম। গোল্ড লীফ বিলাচ্ছে বাবা দেদার হস্তে। এক কথা -একটু দেইখেন যেন পাস করতে পারে।

দাদা হজ্জ্ব করে আসার পর দুনিয়াদারীতে আর অত সময় দেন না। তিনিও দেখি দৌড়াচ্ছেন। আমার দাদী বিশাল পাতিলে ভাত রেধে রেখেছেন। দল বেধে ছেলেরা আসে,খায়, রেস্ট নেয়। এরপর আবার ক্যাম্পেইনের দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। হূলস্থূল কাজকারবার। আমি শুধু সাথে থাকছি। এইটুকুই।
পরদিন নির্বাচন। আমি কেন্দ্রের কাছের চায়ের স্টলে আশ্রয় নিয়েছি। যেই ভোট দিতে আসে তাকেই চা খাওয়াচ্ছি। গভীর রাতে ছেলেরা দ্বিতীয় দফা টাকা দিয়ে আসছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সকালে আর টাকা দেয়া হবে না।
কেন্রের সামনে দাড়িয়েও আমার কাছে একজন টাকা চাইল। ভোট দিতে আসছি। চা খামু না। টাকা দেন।


আমি যা বুঝে আসলাম, টাকা থাকলে আপনি নির্বাচনে জিতবেন। টাকা না থাকলে আপনি সৎ নাকি অসৎ -কোনো ব্যাপার না। হার নিশ্চিত।
যতদিন আমরা শিক্ষিত জাতি না হতে পারলাম, ততদিন নির্বাচন একটা আমেজ, একটা উৎসব, একটা খেলা।

1 comment:

Al amin said...

মানুষ বড় স্বার্থপর। এই জনগনের প্রতি যেন কারো কোন দ্বায়িত্বই নেই। মেধাবীরা পলাতক...