আমার পতনের গল্প

আমার ছোটবোনটার খুব জ্বর কয়েকদিন ধরে। থার্মোমিটার হারিয়ে গেছে। নতুন একটা কিনে আনা হল। সেটাতে জ্বর মেপে দেখি একশ ছয় আর সাতে ঘুরাঘুরি করছে। গায়ে হাত দিলে বোঝা যায় বেশ জ্বর। তাই বলে এত বেশি হতেই পারে না। আমরা ধরেই নিলাম থার্মোমিটারে সমস্যা। বাসার দুইজন ইঞ্জিনীয়ারের মাথায় একবারও এই কথাটা আসল না, ফারেনহাইটের ১০৪ আর ১০৭ এর ভিতর যা পার্থক্য তা আসলে সেলসিয়াসে দেড় ডিগ্রীর মত। এই সামান্য পার্থক্য হাতে বুঝতে পারা সম্ভব না।
ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার ব্লাডের টিপিক্যাল টেস্ট দিল। সেখানে ESR এর মান অনেক বেশি আসছে। আমরা জানি না ESR এর মান বেশি আসলে কি হয়। ডাক্তার শুক্রবার রোগী দেখে না। তাই গুগলে সার্চ মেরে দেখলাম ESR বস্তুটা কি। যা পড়লাম তাতে আক্কেল গুড়ুম। ESR এর মান বেশি আসলে যেসব রোগ হবার সম্ভাবনা তার ভিতর আছে ক্যান্সার, রিমুটিক ফিভার... ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেই রিপোর্টে ব্লাড সেলের সংখ্যা দেখে বুঝলাম আর যাই হোক ক্যান্সার না। ইন্টারনাল ব্লিডিংও হচ্ছে না। ্কিছুটা হাফ ছেড়ে বাচলাম আর কি। পরের দিন আমি আর আমার বাবা অফিস থেকে ছুটি নিলাম। বুঝতে পারছি ঘটনা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে।
ডাক্তারের পরামর্শে পিজিতে নিয়ে anti CCP টেস্ট করে নিয়ে আসলাম। গুগলে ESR এর সার্চ দেয়ার পর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর যাই হোক কিছুতেই গুগলে সার্চ দিবনা। হেভি ভয় খাইছিলাম সেইবার। কিন্তু নয়া রিপোর্ট হাতে পেয়ে তর সইলো না। PDA তেই গুগল সার্চ দিলাম। ইয়াপ! পজেটিভ আসছে। শুধু পজিটিভ না, অস্বাভাবিক বেশি আসছে। মোটামুটি শিওর হয়ে গেলাম হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
তবু একবার ডাক্তারকে দেখিয়ে নিলাম। ডাক্তার ইসলামী হাসপাতালে বসেন, সেখানে ভর্তি হতে বলে দিলেন। আমরা রিসেপশনে গিয়ে জানলাম আপাতত কিছু খালি নাই, সকালে খালি হবে। সকাল মানে হোটেলের মত বারোটায় চেক আউট।
পরদিন সকালে মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল। আমার ছোটবোনের শরীর অস্বাভাবিক রকমের শীতল হয়ে পড়েছে। সে কথা বলতে পারছে না। কেউ ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকছে। অতি ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। আমার পড়িমরি করে একটা সিনএনজি ডেকে ইসলামী ব্যাঙ্ক হাসপাতালেই নিয়ে আসলাম। যে ডাক্তার তাকে দেখছে, সে ত এখানে ভর্তির কথা বলেছে।
হাসপাতালে এনে হুইল চেয়ারে বসিয়ে রেখে ভর্তির ব্যাপারে খোজ নিতে গেলাম। কেবিন নাই। ওয়ার্ড চাইলাম- সেইটাও নাই। ইমার্জেন্সীর ডাক্তার চাইলাম। আছে। নিয়ে গেলাম তার কাছে। মধ্যত্রিশের এই ডাক্তার আমাকে অবাক করে দিল। তার নাম কি আমি জানি না। তাই ব্লগে তাকে শুয়োরের বাচ্চা-১ বলেই উল্লেখ করছি।( বাকি নম্বরের গুলাও আসছে) শুয়োরের বাচ্চা-১ আমার ছোটবোনটার শরীরের অস্বাভাবিক কম তাপমাত্রা দেখল। এরপর বলল, ভর্তি সেকশনে যোগাযোগ করেন। আমরা যতবারই বলি ভর্তি হবার মত সীট খালি নাই। বারোটার দিকে খালি হতে পারে –কাউন্টার থেকে এমনই জানিয়েছে। সে ততবারই বলে যোগাযোগ করেন। এরপর শুয়োরের বাচ্চা জাস্ট হাত গুটিয়ে বসে রইল। আমরা যদি ভর্তি না হই তাহলে এখনকার চিকিৎসার কোন বিল সে নাও পেতে পারে, এই ভয়ে সে হাত দিবে না। আগে আমাদের ভর্তি হতে হবে। টাকা জমা দিতে হবে- এরপর চিকিৎসা। আমরা কাউন্টারে গেলাম। তারা জানাল খালি হতে পারে। তার চেক করে বলবে। এই ফাকে তারা জেনে নিল আমার ছোটবোন কি অপারশনের রূগী না মেডিসিনের।
পরে জানাল সীট নাই। বারোটার পর ওয়ার্ডে ভর্তি হলেও হতে পারে। আমি আর আমার বাবা তখন মাথায় আর কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। টাকা ত সমস্যা না। চিকিৎসা ত শুরু করুক। বোনের যে অবস্থা তাকে আবার গাড়িতে করে কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না। ডাক্তাররা কেউ ত কিছুই বলছে না। ফিরেও দেখছে না। যদি কারো পায়ে ধরলে কিছু হত, আমি মনে হয় তখন পায়েও ধরতাম। কিন্তু কেউ ত পাত্তাই দিচ্ছে না। একজন মানুষ ভয়াবহ অসুস্থ, সে কারো বোন-কারো কন্যা, কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না।
একজন রূগীর দর্শনার্থী আসল কথা ফাস করল। অপারেশনের রূগী না হলে এরা ভর্তি করবে না। খালি মেডিসিন দিলে কত টাকা আর বিল হবে? তিনিই বুদ্ধি দিলেন আশেপাশের কোন একটা হাসপাতালে আপাতত নিয়ে যেতে।
আমি বের হয়ে আসলাম। কাছেই আল বারাকাহ হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে খোজ নিলাম সীট খালি আছে? ডাক্তার আছে? তারা জানালো আছে। ছোটবোনকে নিয়ে আসলাম।
আল বারাকাহ এর রিসেপশনিষ্ট এরপর আমাকে জানাল ইমারজেন্সীতে নিয়ে যান। আমি যতই বলি কোন একজন ডাক্তারকে ডাকেন। তার চিকিৎসা শুরু হোক। তারা ততই বলে অপেক্ষা করেন। এরা দুইজনেই তখন মোবাইলে কথা বলছে মিষ্টি করে কার সাথে জানি না। সকাল নয়টা তখনো বাজে না। মোবাইল কোম্পানীগুলার বিশেষ অফার তখনো চলমান। এরা ফোনের ফাকে ফাকে বলল ডাক্তার আসবে। দেখবে। ঠিক করবে রোগী ভর্তি করা যাবে কিনা। এরপর চিকিৎসা শুরু হবে।
এই পর্যায়ে আমার গলার স্বরে রাগ চলে আসছিলো। একটু গলা চড়াইছি । দুইজনেই মোবাইলে কথা বন্ধ করল। এরপর শুরু করল আমাকে জ্ঞান দান। এইভাবে কেনো কথা বলি আমি? সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে। সিস্টেমের বাইরে যাওয়া যাবে না। এইটা হাসপাতাল। ধমক ধামকে কাজ হবে না।
আমার বাবা আর মা ছোটবোনকে নিয়ে অসহায় মুখে বসে আছে ইমার্জেন্সীতে। আমি বুঝলাম এইভাবে কাজ হবে না। I HAVE TO SUCK LIKE I NEVER HAD SUCKED BEFORE. আমি তাই করলাম। শুয়োরের বাচ্চা-২ আর শুয়োরের বাচ্চা-৩ কে ভজাইলাম। এরপর হারামজাদা ফোন করল। ডাক্তার আসল।


(পরে লিখব বাকিটুকু)

No comments: