ট্রেন

কাউন্টার যে লোক বসে আছে সে জানাল ট্রেন আসবে চারটা নয় মিনিটে এবং স্টেশন ছেড়ে যাবে চারটা তেরো মিনিটে। আমি হাসি দিয়েই টিকিট নিলাম। মনে মনে বলি শ্যালক আমি না হয় প্রথমবার ট্রেনে উঠছি কিন্তু জনশ্রুতি আমার জানা আছে। চারটার ট্রেন পাচটায় এলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। আলামিন আর সুহাদকে নিয়ে স্টেশনের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। আমরা আছি ফেনীতে । থিসিসের কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসছি। যদিও বাস আছে। আমার পীড়াপীড়িতে ট্রেন ভ্রমন। আমি এর আগে কোনদিন ট্রেনে চড়িনি। তাই খুব চাপাচাপি করলাম। আলামিন আর সুহাদ খুবই ভালো মানুষ। সহজেই রাজি হল।
চারটার দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে স্টেশনে আসলাম। কিছু ছবি তুলব। ছবির জন্য ঠিকমত দাড়াতে না দাড়াতেই ট্রেন উপস্থিত। আমি ঘড়ি দেখলাম। ঠিক চারটা নয় বাজে। টকিটে বগির নম্বর লেখা ছিল। সেটা দেখে বগিটা খুজে বের করলাম। আমার ধারনা ছিল ট্রেন আসলে রাজ্যের সব মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে উঠার চেষ্টা করবে। ভিড়ের ভিতর মারামারি করে উঠতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তেমন একটা ভিড় নাই। হাল্কা ঠেলাঠেলি করে উঠে পড়লাম। আমি বেশ খুশী। ট্রেনে টিকিটে সীট নম্বর দেয়া আছে। খুজে খুজে সীতটের কাছেও চলে এলাম।
আমাদের সীটে বিকট দর্শন এক ছেলে বসে আছে। এককানে দুল পড়া। বিরাট পাঙ্ক আরকি। আমি ঠিক শিওর না তাকে বলব সীত ছেড়ে দিন এটা আমাদের। ভাবলাম একটূ দাঁড়িয়ে থাকি। চেকার -ফেকার কেউ আসলে তাকে বলে কয়ে সীট উদ্ধার করব। কিন্তু সুহাদ আমার পিছন থেকে গলা বাড়িয়ে পাঙ্ককে বলল ভাই এইটা আমাদের সীট। পাঙ্ক আমার দিকে তাকাতে আমার মনে হল এই ব্যাটা মাইর না দেয় আবার। শালার সুহাদের জন্য আমাকে না হয় হাসপাতাল ঘুরে আসতে হয়। দেখাই যাচ্ছে আমাদের সীটে মান্যগন্য একজন বসে আছেন। ঘন্টা-খানেক তার সম্মানে দাঁড়িয়ে থাকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত। যাও এখন ঘন্টা-খানেক দাঁড়িয়ে থাকার বদলে মাস খানেক শুয়ে থাকার এন্তেজাম হয়ে গেল। আমার মা সব সময় বলে তুমি যদি ডুবো ত বন্ধুদের জন্যই ডুববা।
কিন্তু আমার মাকে ভুল প্রমান করে, আমার আশঙ্কাকে অমূলক প্রমান করে পাঙ্ক ঊঠে পড়ল। আমি বেশ অবাক। এইটা কি হল? মার খেলাম না! মনে মনে অললাম আরে পাঙ্কু নিদেনপক্ষে একটু কড়া চোখে ত তাকাবি। তা না তোকে সুহাদ বলল উঠতে আর তুই উঠে পড়লি। শুধু শুধূই তুই এককানে দুল পড়োস। বাসায় গিয়েই দুই কানে দুল পড়িস আর হাতে পড়িস চুড়ি।
সুয়াদ সীটের দিকে আগাতেই আমি বললাম খবরদার! জানাল্র পাশের সীট মামার!
সীটে বসার পরপরই ট্রেন ছাড়ল। আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। চারটা তেরো ! কে যে বলে বাংলাদেশের ট্রেন ঠিক সময় ছাড়ে না। ট্রেন একটু দুলে দুলে চলতে শুরু করল। আমি তখন সদ্যই রেলের ওপর একটা কোর্স করেছি। আমি জানি কোন দোষে বা ত্রুটিতে রেল দুলে দুলে চলে আর কেন শব্দ হয়। এই ত্রুটি কিভাবে দূড় করতে হয় সেটাও জানা আছে। কিন্তু যখন একটু স্পীদ বাড়ল আর সেই সাথে দুলুনি তখন আমার মনে হল এইভাবে না দুললে সেটা কোন ট্রেনই না। কে বলে এটা ত্রুটি। তার গলা আমি নিজে হাতে টিপে ধরব।
সারাটা পত আমি কুত্তার মত জানালা দিয়ে গলা বের করে বাংলার গ্রাম দেখতে থাকি। খুব সাধারন সব দৃশ্য। ফসলের ক্ষেত। রাস্তার পাশের বেধে রাখা গরু আর তার তার বিমর্ষ ডাক। কিছু পাখির ঘরে ফেরা। সুর্যটা যেন দূরের গ্রামটার ঠিক পিছনে ডুবে যাচ্ছে। আকাশটাকে রঙ্গিন মনে হচ্ছিল। কিছু ছেলে লাইনের পাশে খেলছে। এই দৃশ্যগুলো দেখেই আমি মুগ্ধ। কি যে গভীর আবেগ অনুভব করলাম। আমার মনে হল এত সুন্দর দেশ আর নাই। ট্রেনের মত ভালো আর কিছু নাই।
একসময় টয়লেট চাপে। বগির মাথায় একটা টয়লেট আছে। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়াবহ ব্যাপার। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করার কোন ব্যাবস্থাআ নাই। বাইরে থেকে ধাক্কা দিলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তার ওপ্র প্যান মোটামুটি খোলা। আমি যা ত্যাগ করব সেটা সরাসরি নিচের রেল লাইনে পড়ে থাকবে। রেল লাইনে হাত ধরাধরি করে প্রেমিক যুগল হেটে যাচ্ছে এই রকম একটা চিরায়ত সুন্দর দৃশ্য আছে। এই টয়লেটে যঢুকার পর সেই দৃশ্য আর আমার কাছে সুন্দর রইল না।
আমি ফিরে এলাম। সীটে বসে কিছুক্ষন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম। এরপর ভাবলাম রাস্তার পাশের দাঁড়িয়ে বাঙ্গালী এই কাজ নিয়মিত করে আর আমি পারব না? সাহস করে ঢূকে যাই। ছোট কাজটা করার সময় কেউ যদি ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ে ত ঢূকে পড়ুক। এইখানে সীটে বসে নিজের ভিতরে এই তরল জমিয়ে রাখার যে কষ্ট তার তুলনায় সেটা কি আর এমন বেশী। সাহস করে চলে গেলাম। তরল কমিয়ে আসলাম। কেউ ধাক্কা দেয় নাই।
আমরা ঢাকার দক্ষিনে ছিলাম। তাই দক্ষিন দিয়ে ঢাকাতে প্রবেশ করা উচিত ছিল। সেটা না করে ঢাকার উত্তর দিয়ে ঢূকলাম। এতে বেশ সময় নষ্ট হল। ঢাকা থেকে ফেনীতে বাসে আসতে যেতে যত সময় লাগে তার চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগল ট্রেনে।

No comments: