রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের কিছু উক্তি

কয়েকদিন ধরে ঘরে বাইরে উপন্যাসটা পড়ছি। সেখান থেকেই কিছু অংশ তুলে দিলাম।
উপন্যাসে চরিত্রের সংখ্যা কম। তিনজন। বিমলা-তার স্বামী নিখিলেশ। লিখিলেশের দোস্ত সন্দীপ। নিখিলেশ রাজবংশের যুবক। অতি মাত্রায় শুদ্ধাচারী। বিমলা সাধারন ঘর থেকে এসেছে। দেখতেও সাধারন। নিখিলেশও সাধারন দেখতে। আর সন্দীপ স্বদেশী নেতা, কর্মবীর।

বিমল এর উক্তি-
রুপ যখন চোখের পাহারা এড়িয়ে লুকিয়ে অন্তরে দেখা দেয় সেই বুঝি ভালো। তখন সে ভক্তির অমরাবতীতে এসে দাঁড়ায়, সেখানে তাকে কোন সাজ করে আসতে হয় না। ( বিমল নিখিলেশের প্রেমে পড়ছে)


আমার নারীর হৃদয়, তার ভালোবাসা আপনিই পূজা করতে চায়। (প্রেম ঘনীভুত হচ্ছে)


তিনি প্রায় রোজ আমাকে একটি করে চিঠি লিখতেন। তার কথা অল্প, তার ভাষা সাদা, তার হাতের গোটা গোটা গোল অক্ষরগুলি যেন স্নিগ্ধ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। (নিখিলেশের চিঠির কথা বলা হচ্ছে)


প্রেম যে স্বভাব বৈরাগী; সে যে পথের ধারে ধূলার পরে আপনার ফুল অজস্র ফুটিয়ে দেয়। সে ত বৈঠকখানার চীনের টবে আপনার ঐশ্বর্য মেলতে পারে না।


আমার মনে হত ভালো হবার একটা সীমা আছে। সেটা পেরিয়ে গেলে কেমন যেন তাতে পৌরুষের ব্যাঘাত হয়। (নিখিলেশের অতি ভালোমানুষির প্রতি বিমলার অবজ্ঞা)


আমার এক এক বার মনে হয় রূপের অভিমানের সু্যগ বিধাতা যদি মেয়েদের দেন তবে অন্য অনেক অভিমানের দুর্গতি থেকে তারা রক্ষা পায়।



নিখিলেশ-

কথা কি মুখের কথাতেই শেষ হয়? সমস্ত জীবনে কত কথা শেষ হয় না।


বিমল-

আমি সত্য কথা বলব। সেদিন আমার মনে হয়েছিল বিধাতা কেন আমাকে আশর্য সুন্দর করে গড়লেন না? কারো মন হরণ করার জন্য যে, তা নয়। কিন্তু রূপ যে একটা গৌরব। ( বিমলের সাথে সন্দীপের মাত্র দেখা হবে)


স্রোতের জন ঘোলা হলেও অনায়াসে তার ব্যবহার চলে। সন্দিপবাবুর সমস্তই এমনি দ্রুতবেগে চলে যে আর একজনের মুখে যা সইত তার ,উখে তাতে আপত্তি করবার ফাক পাওয়া যায় না। (সন্দীপের অতিমাত্রার জোস বিমলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে)


নিখিলেশ

মনকে যখন মনে মনে যাচাই করতুম তখন অনেক দুঃখ কল্পনা করেছি। কখনো ভেবেছি দারিদ্রয়, কখনো ভেবেছি জেলখানা, কখনো অসম্মান, কখনো মৃত্যু। এমনকি কখনো বিমলের মৃত্যুর কথাও ভাবতে চেষ্টা করেছি। এ সমস্তই নমস্কার করে মাথায় করে নেব এ কথা যখন বলেছি বোধ হয় মিথ্যা বলি নি।কেবল একটা কথা কোনদিন কল্পনাও করতে পারি নি। আজ সেই কথাটা নিয়ে সমস্ত দিন বসে বসে ভাবছি, এও কি সইবে? ( বিমলার আগ্রহ সন্দীপের প্রতি, নিখিলেশ সেটা বুঝতে পারছে)


ভালোবাসার ত মূল্য তাই, সে যে অযোগ্যতাকেও সফল করে তুলে। যোগ্যের জন্য পৃথিবীতে অনেক পুরস্কার আছে। অযোগ্যের জন্যই বিধাতা ভালোবাসাটুকু রেখেছেন। (নিখিলেশের নিজের অযোগ্যতার জবাবদিহি)


যদি দেখি এই বিশাল জীবন ব্যবস্থার মধ্যে আর কোথাও আমি খাপ কাইনে তা হলে বুঝব এতদিন যা নিয়ে ছিলাম সে কেবল ফাকি। সেই ফাকিতে কোনো দরকার নাই। সেদিন আসে ত ঝগড়া করব না, আস্তে আস্তে বিদায় হয়ে যাব। জোর – জবরদস্তি? কিসের জন্য! সত্যের সাথে কি জোর খাটে?


সন্দীপের উক্তি-

পুরুষেরা ভালোবাসে ধোয়াকে আর মেয়েরা ভালোবাসে বস্তুকে। সেই জন্যেই পুরুষ পূজা করতে ছুটে তার নিজের আইডিয়ার অবতারকে। আর মেয়েরা তাদের সমস্ত অর্ঘ্য এনে হাজির করে প্রবলের পায়ের তলায়। ( সন্দীপ জানে বিমলা তাকে ছাড়তে পারবে না)

নিখিলেশ-

জীবনের ট্রাজেডি এখানেই। সে ছোটো হয়ে হৃদয়ের এক তলায় লুকিয়ে থাকে। তারপর বড়কে এক মুহুর্তে কাত করে দেয়। মানুষ আপনাকে যা বলে জানে মানুষ তা নয়। সেই জন্যেই এত অঘটন ঘটে।

বিমল প্রানের আবেগে ভরা। সেই জন্যেই এই ন’বছরের মধ্যে এক মুহুর্তের জন্য সে আমার কাছে পুরনো হয় নি। কিন্তু আমার ভিতর যদি কিছু থাকে সে কেবল বোবা গভীরতা। সে ত কলধ্বনিত বেগ নয়। আমি কেবল গ্রহন করতেই পারি। কিন্তু নাড়া দিতে পারি নে। আমার সংগ মানুষের পক্ষে উপবাসের মত। বিমল যে এতদিন কি দুর্ভিক্ষের মধ্যেই ছিল ওকে দেখে বুঝতে পারছি। দোষ দেব কাকে?
হায় রে
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শুন্য মন্দির মোর।
( নিখিলেশ হার মেনে নিচ্ছে নিচ্ছে...)



একজন স্ত্রী লোকের মিলন-বিচ্ছেদের সুখ দুঃখ ছাড়িয়ে এ পৃথিবী অনেক দূর বিস্তৃত। বিপুল মানুষের জীবন। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে তবেই যেন নিজের হাসি কান্নার পরিমাপ করি।
(পুরাপুরি হার মেনে নিয়েছে)

সন্দীপ-
পুরুষেরা যেখানে দুর্বল মেয়েরা সেখানে তাদের খুব ভালো করে চিনে, কিন্তু পুরুষেরা যেখানে খাটি পুরুষ মেয়েরা সেখানকার রহস্য ঠিক ভেদ করতে পারে না।।

বিমলা-
দেবী তার ভক্তের দিকে তাকিয়ে কি রকম যে মুগ্ধ হতে পারেন সেদিন অমূল্যের দিকে তাকিয়ে আমি তা বুঝতে পারলুম। ( অমূল্য - বিমলার ভক্ত, স্বদেশ কর্মী)


নিখিলেশ
দাম্পত্য আমার ভিতরের জিনিস সে ত কেবল আমার গৃহস্থ-আশ্রম বা সংসারযাত্রা নয়।সে আমার জীবনের বিকাশ। সেই জন্যেই বাইরের দিক থেকে ওর ওপর জোর দিতে পারলাম না। দিতে গেলেই মনে হয় আমার দেবতাকে অপমান করছি। ( নিখিলেশ বিমলার প্রতি কোন রকম জোর করছে না)

বিধাতা আমাদের জীবন- ছবির দাগ একটু ঝাপসা করেই টেনে দেন; আমরা নিজের হাতে সেটাকে কিছু-কিছু বদলে মুছে, পুরিয়ে দিয়ে নিজের মনের মত করে নিজের জীবনটা সৃষ্টি করব এই তার অভিপ্রায়। সৃষ্টিকর্তার ইশারা নিয়ে নিজের জীবনটা নিজে সৃষ্টি করে তুলব, একটা বড়ো আইডিয়াকে আমার সমস্তের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে দেখাব এই বেদনা বরাবর আমার মনে আছে।



এই উক্তিগুলোই উপন্যাসের প্রান। আমি সেই প্রানের একটু আভাস মাত্র দিলাম। মূল উপন্যাসটার কাহিনী তেমন একটা বললাম না। এটা ইচ্ছে করেই করা হল। ব্লগাররা যেন উপন্যাসটা পড়ার জন্য আগ্রহবোধ করেনতার জন্যই এটা করা।

No comments: