গল্প- পাতা ঝরার দিন

রাসেল একটু ঝুকে চুমু দিল সীমাকে। সীমাও সাড়া দিল। কিন্তু দ্বিতীয় চুমু দেয়ার আগে রাসেল থেমে গেল। সীমা আগ্রহ নিয়েই মুখ বাড়িয়েছিল। তাই একটু হতাশ হল। তারা দুইজন যাচ্ছে রিকশায়। রাসেল কেয়ার করে না কখন কেউ দেখল কিনা বা কেউ কিছু ভাবল কিনা। আর রাসেল যে শুধু সীমাকেই চুমু দিয়েছে রাস্তায়, তা ত নয়। এর আগে বীথি, নিশা, রত্না ইত্যাদি ইত্যাদি মেয়েকে সে চুমু দিয়েছে হয় রিকশায় বসে না হয় আধা-অন্ধকারে রাস্তার পাশে বসে। রাসেল জানে সীমার ঠোট দুটোতে তার আগেও আরো কারো স্পর্শ ছিল। এই নিয়ে রাসেল কোন চিন্তা করে না। যে ছেলেটা এর আগে সীমার ঠোটে চুমু খেয়েছে আর সিএনজিতে বসে স্তনে হাত দিয়েছে, সেই ছেলেটাকে রাসেল চিনে। ওর নাম সুদীপ্ত। রাসেলের রুমমেট। রাসেল যদিও জানে সুদীপ্ত সীমাকে চুমু দিয়েছে তার এই নিয়ে কোন ধরনের শুচিবায়ুতা নেই। আধুনিক সময়ে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে সে রাজি নয়। বরং নগদ যা পাওয়া যাচ্ছে সেটা উপভোগ করাতেই তার আনন্দ।

সীমা ঠোট দুটো হাতের তালুতে মুছে জিজ্ঞেস করল "কি হয়েছে?" তার চোখে সামান্য জিজ্ঞসা। বিকেলে চা খেয়েছো কিনা সেটা জিজ্ঞেস করার সময়ও এর চেয়ে বেশী উৎসুক্য থাকে তার চোখে। রাসেল রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। কিছু হয়নি। তবে থামলে কেন? জানি না। সীমাকে আসল কারন বলার কোন ইচ্ছা নাই রাসেলের। থামার কারন মনটা খচখচ করছে গতকাল থেকে। এক হাজার টাকা চুরি করা ঠিক হয়নি। অবশ্য এটাকে চুরি বলা যায় না। সরিয়ে ফেলা ঠিক হয়নি বলা উচিত।


গতকাল হলে বসে গেম খেলছে রাসেন। কিছুক্ষন পর টিঊশনীতে যেতে হবে। সেখানে যাবার আগে গেম খেলে মুড ভাল করার চেষ্টা করছে। অতি গর্দভ এক ছাত্রকে পড়াতে যাবে। তাই যাওয়ার আগে মুড অন করা খুবই জরুরী। তার রুমমেট সুদীপ্ত এল। " দোস্ত! আমার মাথা-ব্যথা করছে। " "শুয়ে থাক। কিন্তু রাতে ত কালেকশনে যাওয়ার কথা। স্বপনকে বল। হারামজাদার ত তো্র সাথেই যাওয়ার কথা। স্বপন টিঊশনীতে আটকা পড়েছে। কথা বলতে বলতে রাসেলের মনযোগ সরে গিয়েছিল গেম থেকে। গেম গুলো এমন হয় যে সব ভুল ক্ষমা করা হবে কিন্তু মনযোগের অভাব ক্ষমা হবে না। রাসেল গালি দিল একটা। কপিটারের গালি-গালাজে কিছু আসে যায় না। রাসেল গেম pause করল। " তুই যা প্রদীপের সাথে। " তোর কাজ আমি করব কেন? তোকে স্টারে খাওয়াব। হুমম রাসেল একটু দুর্বল হয়। তা ছাড়া টাকা তোলা হচ্ছে একটা মহৎ কাজের জন্য। অন্য ভার্সিটির একটা ছেলে অসুস্থ হয়েছে। তার চিকিৎসার জন্য টাকা তোলা হবে। রাসেল বলল ঠিক আছে। আমি রাতে এসে বের হব। রাসেল ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা আসলে একটা খুব ভালো health insurance করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে কিডনী-লিভার যাই নষ্ট হোক বা ক্যান্সার হোক ছেলেরা টাকা পয়সা তুলে তার চিকিৎসা করবে। কখনও শোনা যায় না ভার্সিটির কোন ছাত্র বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। যেভাবেই হোক টাকা যোগাড় হবে। এইদানিং শুরু হয়েছে নতুন স্টাইল। কনসার্ট আয়োজন করা। কনসার্টে আসো। নাচো- গাও। কেউ নিয়ে আসে বান্ধবী। নাচো একসাথে। কেউ খাবে মদ-গাজা। আর তাদের টিকিটের টাকা দিয়ে মাদ্রাজ-সিঙ্গাপুরে হবে মধ্যবিত্তের কোন ছেলের কিডনী ঠিক হচ্ছে বা চোখ। সবাই খুশী। এটা সবার জন্যই win-win situation.পাচশত কিলোমিটার দূরের ভার্সিটির কোন এক অখ্যাত-মেধাবী ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে আর তার জন্য রাসেলকে হলের বিভিন্ন রুমে গিয়ে গিয়ে টাকা তুলতে হবে।

.........তুমি কি জানো অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র মারা যাচ্ছে? তোমার সামান্য সাহায্য একটা ছেলের জীবন বাচাতে পারে। আমারা একটা পোস্টার দিয়েছিলাম ডাইনিং হলে। তুমি কি সেটা দেখেছো? সেখানে লেখা ছিল যে আজকে আমরা টাকা তুলতে আসব। তোমার যদি মনে হয় সাহায্য করা দরকার তাহলে তুমি সাধ্যমত টাকা দিতে পারো। যে যাই দিচ্ছে আমরা তাই নিচ্ছি।......

প্রদীপ কথাগুলো বলে। রাসেলকে শুধু টাকাটা হাতে নিতে হয়। এরপর ঢুকিয়ে রাখে একটা বক্সে। রুমে রুমে ঘুরে বেশ ভালো টাকা উঠছে। বারোটার দিকে শেষ হয় টাকা তোলা। প্রদীপ প্রচুর কথা বলে বলে ক্লান্ত। রাসেলকে বলে পনেরটা টাকা দে বাক্স থেকে। ক্যান্টিনে গিয়ে কোক আর সিগারেট খাই। রাসেলের চেহারায় নিশ্চয় অবাক একটা ভাব ফুটে উঠেছিল।নইলে প্রদীপ বলত না। এইরকম করে তাকাস ক্যান? এইটা হইল সিস্টেম লস। এইটা থাকবই। রাসেল বাক্স থেকে ত্রিশ টাকা বের করে। তুই গিয়ে বস। আমি টয়লেট ঘুরে আসি একটু।
এই টয়লেটে গিয়েই রাসেল হাজারখানেক টাকা সরিয়ে ফেলে বাক্স থেকে।

রাত দুইটা পর্যন্ত সীমার সাথে কথা হল। পরদিন ডেটের ব্যাপারটা নিশ্চিত করেই রাসেল ঘুমাতে যায়। তারা যাবে সিনেমা দেখতে একটা সিনে কমপ্লেক্সে।
ঘটনাটা এতটুকুই। হাজারখানেক টাকা সরিয়ে ফেলার জন্য রাসেলের মনে একটু খচ খচ করতে থাকে। যদিও ত্রিশ টাকা সরানো আর হাজার টাকা সরানো একই জিনিস। শুধু পরিমানে হাজারটাকা ত্রিশ টাকা থেকে বেশী। তবু একটা অসুস্থ ছেলের চিকিৎসার টাকা সরিয়ে নিয়ে সে স্বস্তিবোধ করেনা। মধ্যবিত্ত মুল্যবোধের সবটুকু এখনো যায় নি দেখে সে নিজেই একটু অবাক। তার ধারনা ছিল এই ধরনের মান্ধাতার আমলের মূল্যবোধ সে পার হয়ে এসেছে। যেদিন রাখিকে সে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরেছিল আর জোর করে দিয়েছিল একটা চুমু সেদিন তার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ বেশ যন্ত্রনা দিয়েছিল। এরপর বহুদিন পার হয়েছে। কিন্তু এতদিনেও যে পুরোপুরি যায়নি সাবেকি চিন্তা সেটা আবিষ্কার করে রাসেল দুঃখিত।
রিকশা থেমে গেল ফুলার রোডে। রাস্তার পাশে বসল দুইজন। আজকে সীমাকে দ্বিতীয় চুমু দিতে গিয়ে তার ভিতর এতগুলো চিন্তা একসাথে এল যে আগ্রহই চলে গেল। সীমা বেশ আধুনিক। সাড়া দেয় সবসমই ভালো। তবুও মনের ভিতর থেকে আজ জোর পাচ্ছে না।
সীমা রাসেলের হাত ধরল। তুমি কি বলবে তোমার কি হয়েছে? রাসেলের মনে হচ্ছে সীমার এখনো কোন আগ্রহ নাই জানার। শুধু অভিনয়। রাসেল সীমার কাছ ঘেষে বসল। সিনেমা শুরু হতে দেরী আছে আরো। আরেকবার চুমু দিবে??
সিধান্তটা নেয়ার আগেই ফোন বেজে উঠেছে। মা করেছে ফোন। রাসেল একটু বিরক্ত। ঝামেলা ভালো লাগে না।
-কি হইছে?
-রাশেদের শরীর গতরাত থেকে খারাপ।
রাসেলের বুক ধক করে উঠল। ছোটভাইটাকে সে ভালোবাসে খুব বেশী। বয়সের ব্যাবধান বেশী থাকায় ছোট ভাইয়ের সাথে কোনদিন ঝগড়া হয়নি। বরং রাসেল তার ভাইকে আদর করে অপরিমিত।
-কি হইছে রাশেদের?
-রাত বারোটার দিকে হঠাৎ করেই গায়ে র‌্যাশ বের হইছে? বারোটার কথা শুনে আবার হার্টবিট মিস হল একটা। ঠিক বারোটার দিকেই ত রাসেল হাজারখানেক টাকা সরিয়েছে।
-র‌্যাশ?
-হু।
-তোমরা আমাকে বল নাই কেন? ডাক্তার দেখাইছো?
-রাইতে ছদুর অইখান থেকে ওষুধ এনে খাওইয়াছি। র‌্যাশ কমছে। ডাক্তার দেখাইছি। মনে হয় এলার্জি। সিরিয়াস কিছু না।
-ডাক্তার কি বলে?
-টেস্ট দিছে। রিপোর্ট দিবে বিকালে। এরপর সন্ধ্যায় দেখাব ডাক্তারকে।
- আমারে কিন্তু সাথে সাথে জানাবে কি বলে ডাক্তার।



রাসেলের মাথার ভিতর আজেবাজে চিন্তারা ঘুরাঘুরি শুরু করেছে। ঠিক বারোটার দিকে সে যখন অসুস্থ এক ছেলের চিকিৎসার টাকা নিজের পকেটে ভরছে তখনি তার ছোট ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাসেল ধর্ম মানে না খুব একটা। তাই ভাবে ব্যাপারটা কাকতাল হতে পারে। দেখা যাক রিপোর্ট কি আসে। কিন্তু এরপর সিনেমা দেখার আর মূড থাকেনা রাসেলের। কিন্তু ফিরেও যায় না। হাজার খানেক টাকা আছে পকেটে। সীমাকে নিয়ে দুপুরে খায়। সিনেমা দেখে।
বিকালে বাসায় ফোন করে। রাশেদের কি অবস্থা?
এখন একটু ভালো। তবে র‌্যাশ যায় নি।
ডাক্তার কি বলে?
যাইনি ত এখনো ডাক্তারের কাছে।
তাহলে তাড়াতাড়ি যাও।
তাড়াহুড়া করলে হবে? ডাক্তার না আসলে দেখাব কাকে? মায়ের মনে বড়ভাইয়ের ছোটভাইয়ের জন্য এইচিন্তাটা ভালো লাগে।
চিন্তা কর না। কিছুই হবে সিরিয়াস।
ধুর। তুমি তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যাও।
রসেলের কিছুই ভালো লাগে না। ছোটভাইটার জন্য মন ধুকধুক করতে থাকে। তার পাপে কি রাশেদ কষ্ট পাচ্ছে? সে অনেকদিন পর আসরের নামাজ পড়ল। খোদাকে বলল আমি আর কোনদিন এইরক্ম কাজ করব না। তুমি রাশেদকে কষ্ট দিও না। রুমে ফিরেই প্রদীপকে ফোন করে রাসেল।
দোস্ত তুই কই?
ক্যাম্পাসেই আছি।
টাকা জমা দিসোস
কিসের টাকা?
অইযে রাইতে তুললাম।
না জমা দেই নাই।
দোস্ত এককাজ করবি তুই? আজকে জমা দিস না। আমি আলাদা করে কিছু ডোনেশন করমু।
ক্যান?
করমু। একটা পোলা মারা যাচ্ছে। আর আমার ত বেশ টাকা জমে আছে ব্যাঙ্কে। স্কলারশীপের হাজার পাচেক আছে।
পাচ হাজার দিবি?
না। হাজারদুই দিমুনে। তুই আজকে কালেক্টের টাকাগুলো সেন্টারে জমা দিস না।
আইচ্ছা।
ফোন শেষ করে রাসেলের ভালো লাগে। হাজার দুই যাক। তবু রাশেদের যেন কিছু না হয়।

রাত আটটার দিকে রাসেলের মা ফোন করে।
ডাক্তার কি বলে?
বলল ত সিরিয়াস কিছু না। এলার্জির কিছু ঔষুধ দিয়ছে।
রাসেলের বুকের ভিতর থেকে শ্বাস বের হয়। যেন অনেকক্ষন তার দম বন্ধ ছিল।

পরদিন প্রদীপ আসল।
দোস্ত তোরে শুধু শধু কিপটা বলি। তুই ত ভালো মানুষরে।
রাসেল হাসে। হাসিতে প্রান নাই।
প্রদীপ আমি যে তোরে টাকা দিমু এটা কাউরে বলছোস?
না
দোস্ত তোর সাথে একটা কথা আছে জরুরী।
বল।
দোস্ত আমি ত টাকাটা দিতে পারমু না। বিরাট দরকার পড়ছে আমার টাকার।
গতকালকে না বললি দিবি?
গতকালকে ত টাকাটার এত দরকার ছিল না।
কিসের জন্য টাকা দরকার ? আমাকে বল।
দোস্ত সেটা বলা যাবে না।
রাসেল পরের সপ্তাহে সীমাকে নিয়ে সেন্ট-মার্টিন যায়। সেটা আরেক গল্প।

No comments: